সুচনাঃ

একঘেয়েমির জীবন আর কর্ম ব্যাস্ততাকে দুই দিনের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, নির্জন সবুজ বনানী, পাখিদের কোলাহল আর স্বচ্ছ জলের আয়নায় একটু প্রাণশক্তি খুঁজে নেওয়ার আশায় আমরা চলে এসেছি বান্দরবন। বান্দরবন আমাকে কখনো নিরাশ করেনি। সবসময়ই প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির পাল্লা ভারি করেই ফিরেছি বান্দরবন থেকে। এবারের দুইদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনায় আছে সাঙ্গু নদীতে স্নিগ্ধ একটা বিকেল কাটানোর আর একটা দিন দেবতাখুম এর নির্জন, শীতল সৌন্দর্য উপভোগ করার।

যাত্রা শুরুঃ

আমরা আমাদের হোটেল গ্রিন পিক থেকে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা হয়েছি দেবতাখুম এর উদ্দেশ্যে। আমাদের গাড়িতে আমাদের সাথে সারাদিনের জন্য একজন গাইড থাকছেন। আমরা এখানে আসার আগেই ওনার সাথে ফোনে যোগাযোগ সম্পন্ন করে রেখেছিলাম। খাবার দাবার আর গাড়ির বন্দোবস্ত আমাদের গাইড সাহেব আগে থেকেই করে রেখেছিলেন।

যাত্রা পথেঃ

যাত্রাপথে আমরা দাঁড়ালাম রোয়াংছড়ি পর্যটক গাইড কল্যান সমিতির অফিসের সামনে। এই জায়গাটি রোয়াংছড়ি থানার থিক উল্টো পাশেই। দেবতাখুম যেতে হলে সাথে অবশ্যই গাইড নিতে হবে আর আপনারা এখান থেকে এন্ট্রি করিয়ে সাথে গাইড নিয়ে নিতে পারবেন। আমাদের গাইড এখানে কিছু প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষ করার পর আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।

ভ্রমণ প্রস্তূতিঃ

রোয়াংছড়ি থানা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছি লিরাগই কচ্ছপতলি বাজারের দিকে। হোটেল গ্রিন পিক থেকে লিরাগই কচ্ছপতলি বাজারের দূরত্ব ২৯.৩ কিলোমিটার। লিরাগই কচ্ছপতলি বাজার-এ আসতে আমাদের সর্বমোট ১ ঘন্টার ১৫ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। এখানে আমাদের পর্যটকদের একটি তালিকা এখানকার আর্মি ক্যাম্প-এ জমা দিয়ে তারপর আমরা দেবতাখুম যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র পাবো। খুমে যাবার পথটা উঁচু নিচু আর পাঁথরের ধাঁর থাকায় ট্র্যাকিং এর জন্য সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। তাই আমরা এই বাজার থেকে ১৫০ টাকা করে রাবারের এক বিশেষ ধরনের পাদুকা কিনে নিলাম আর যাত্রা আর ট্র্যাকিং শুরু করলাম দেবতাখুম এর দিকে।

খাবার ও অন্যান্যঃ

ফেরার পথে আমরা লিরাগই কচ্ছপতলি বাজারেই দুপুরের খাবার সেরে নিবো। এখানে ready to serve কোন খাবার থাকেনা তাই খুমের পথে যাত্রা শুরু করার আগেই এখানে খাবারের অর্ডার করে যেতে পারেন।
ঝিরির পথ ধরে আমাদেরকে প্রায় ৩ কিলোমিটার এর মতো রাস্তা পায়ে হেটে পৌছাতে হবে শিলবান্ধা পাড়ায়। শিলবান্ধা পাড়া থেকে আরো ১০ মিনিটের মতো হাটলেই আমরা পৌঁছে যাব দেবতাখুম। ঝিরির পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে দারুণ উপভোগ্য মনে হয়েছে। চলুন এই নির্মল প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেবতাখুম ভ্রমণের খরচাদি আর দেবতাখুম সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

যা জানার আছে দেবতাখুম সম্পর্কেঃ

দেবতাখুম (Debotakhum) বান্দরবন জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবন এর উল্লেখযোগ্য খুম গুলর মধ্যে রয়েছে সাতভাই খুম, ভেলাখুম, আমিয়াখুম, শিয়াখাবা খুম, মাথভরা খুম, নাইয়াখাং খুম, নাফাখুম, দেবতাখুম। খুম মানে জলাধার, যেখানে জল আটকে থাকে। খুম গুলর মধ্যে দেবতাখুম নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সুন্দর এবং সহজে ভ্রমণযোগ্য। দেবতাখুম এর (Debotakhum) স্থানীয় নাম নাই আইং।
দেবতাখুম এর গভীরতা ৫০-৭০ ফিট এবং এটি ৬০০ মিটার দীর্ঘ। দেবতাখুম এর অবয়ব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে কাল ও প্রকৃতির বিবর্তনে পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাটলের কারনে দেবতাখুম সৃষ্টি হয়েছে।

দেবতাখুম ভ্রমণের যাবতীয় খরচ ও অন্যান্যঃ

এবার খরচের কথায় আসি। ঢাকা থেকে বান্দরবন এ আসতে নন এসি বাসে ৭০০ টাকা এবং ধরণ ভেদে এসি বাসে ১২০০-১৬০০ টাকা খরচ পড়বে। বান্দরবন শহর থেকে লিরাগই কচ্ছপতলি বাজারে আসতে পারবেন বাসে, সিএনজি অটোতে এবং জিপ বা চাঁদের গাড়িতে। বাসে জনপ্রতি ৭৫-৯০ টাকা, রিজার্ভ সিএনজি অটো ৫০০-৭০০ টাকা এবং জিপ বা চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ সময়ভেদে ৩৫০০-৫০০০ টাকার ভেতর ওঠানামা করে। খাবারের খরচটা খাবারের ধরণ ও পরিমানের উপর নির্ভরশীল তাই আমাদের খাবারের খরচটা আর শেয়ার করছিনা, তবে খাবারের মান অনুযায়ী এখানে খাবারের দাম আমার কাছে সাশ্রয়ী মনে হয়েছে। এছাড়া গাইড এর জন্য ১০০০-১২০০ টাকা খরচ হবে। রোয়াংছড়ি থানা ও লিরাগই কচ্ছপতলি আর্মি চেকপোস্ট-এ এন্ট্রির কাজটা গাইড-ই সম্পন্ন করে দেবে। এছাড়াও নৌকা পাড়াপাড়, লাইফ জ্যাকেট ও ভেলা ভাড়া বাবদ আরো ১৫০ টাকা খরচ হবে দেবতাখুম-এ।

শিলবান্ধা পাড়াঃ

প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তা ঝিরিপথ ধরে হাঁটার পর আমরা এসে পৌছালাম শিলবান্ধা পাড়ায় (Shilbandha Para)। এখানে মারমা উপজাতিদের বসবাস। প্রযুক্তি আর ইট পাথরের ভিড়ে আমাদের প্রকৃত গ্রামীণ জীবনধারা হারিয়ে যেতে বসলেও এই শিলবাঁধা পাড়ায় মাটি ও মানুষের অবিকৃত গ্রাম এখনো টিকে আছে।
শিলবান্ধা পাড়া (Shilbandha Para) থেকে নেমে অল্প কিছু পথ হাটলেই দেবতাখুম। মাঝে পর্যটকদের বসার ও হাল্কা নাস্তার জন্য ২/৩ টি টং দোকান আছে। এখানে ছোট্ট একটি ব্রেক নিয়ে নিতে পারেন প্রয়োজনে।

দেবতাখুম এ ভেলা ভ্রমণ আর দেবতা পাঁথরের কথাঃ

বিরতির পরে আর অল্প কিছুটা পথ হেটে আমরা পৌঁছে গেলাম দেবতাখুম এর খুব কাছে। এখানে ছোট্ট একটা খুম আছে এর নাম পং সু অং খুম (Pong Shu Ong Khum)। এই খুম পার হওয়ার জন্য ছোট ছোট দুইটি ডিঙ্গি নৌকার ব্যাবস্থা আছে এখানে। অনেক অতি উৎসাহী লোকজন পং সু অং খুম সাঁতার কেটেই পার হয়ে যাচ্ছেন। ডিঙ্গি নৌকা থেকে নেমে লাইফ জ্যাকেট সংগ্রহ করে ভেলার সিরিয়াল পাওয়ার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর শুরু হলো আমাদের প্রতিক্ষিত দেবতাখুম ভেলা ভ্রমণ।
ভেলা ভাসিয়ে কিছুটা সামনে এগোতেই শুকনো চর এর মতো একটা জায়গা চোখে পরে যাবে। এখানে বড় এবং পানিতে অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় যে পাথরটি রয়েছে এর নাম দেবতা পাথর। স্থানীয়দের মাঝে মিথ প্রচলিত আছে যে, দেবতাখুম-এ লোক সমাগম কম থাকলে এই পাঁথরের চতুর্দিকে মাছেরা ভিড় করে আর তৃষ্ণা মেটায়। কিন্তু এই মাছগুলো সবসময়-ই অধরা থেকে যায়। স্থানীয় মারমা উপজাতীয় মানুষ তাদের শান্তি, সমৃদ্ধি আর মঙ্গল কামনায় এই পাঁথর দেবতার পূজা অর্চনা করে থাকে।

দেবতাখুম ভ্রমণ গাইড নাম্বারঃ

আলি আল রাহাতঃ ০১৮৬৬৪২৪৪৪৪
রুন্ময় লালঃ ০১৮৫৭২৭২০৯৫
রকিঃ ০১৮৫৫৩৬০২৬৪

সতর্কতা, প্রস্তুতি ও অন্যান্য তথ্যাদিঃ

  • কচ্ছপ্তলি আর্মি ক্যাম্পে রিপোরটিং এর জন্য সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখতে হবে।
  • দেবতাখুম ভ্রমণের জন্য সাথে গাইড নিয়ে নিতে হবে।
  • কচ্ছপ্তলির পরে ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না।
  • দেবতাখুম বা শিলবান্ধা পাড়ায় ক্যাম্পিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  • ট্র্যাকিং এর জন্য সাথে ট্র্যাকিং ফ্রেন্ডলি জুতা বা স্যান্ডেল নিয়ে নিতে হবে।
  • সাঁতার না জানলে পানিতে নামবেন না।

Tagged in:

, , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , ,