ঢাকা থেকে বাস ও লঞ্চ এ ৪০৫ কিলোমিটার এর যাত্রা করে এসেছিলাম দেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপে । গত দুই দিনে আমরা ঘুরে দেখেছি এই দিপের রুপ লাবণ্য, সৌন্দর্য আর প্রকৃতি। মনোমুগ্ধকর সমুদ্র, এর জল ছোঁওয়া নির্ভেজাল বাতাস এখানে থাকা প্রীতিটি মুহূর্তকে আরো উপভোগ্য করেছে। সূর্যাস্তের লাল আভা স্মৃতির পাতায় আগুন জালিয়ে যাবে অনেকদিন। এই সৌন্দর্য ভোলার নয়, এমন সৌন্দর্য ভোলা যায় না। সকালে ঢেউ এর গর্জনে ঘুম ভাঙা, হোটেল এর লবিতে আছড়ে পরা ঢেউ গুনে পার করা সময়গুলি সাথে নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি চোখ বুজলেই আবার আমি এ সমুদ্রের কিনারাতেই ফিরে আসবো। এ নোনা জল, হিমেল হাওয়া ভুলে যাবার নয়। এ স্বাদ অনন্য, অতুলনীয়। তীরের বালুচরে সাইকেল চালিয়ে ছেড়াদ্বিপ যাওয়ার গল্পটাও সাথে নিয়ে যাচ্ছি। গল্পের আসরগুলোতে এমন গল্প থাকতে হয়। সাথে নিয়ে যাচ্ছি ছেড়াদ্বীপের কোরাল, কেয়াবন, গোল্লা আইসক্রিম এর গল্প, এখানকার জোয়ার ভাটার গল্প। এবার বিদায় বেলা, এবার বারি ফেরার পালা। আমাদের এবারে ভ্রমণ এম ভি বে ওয়ান ক্রুস শিপ এ।

সেইন্টমারটিন জেটি ঘাটে দাড়িয়ে থাকা এম ভি আব্দুল মতিন-এ করে আমাদের যেতে হবে আরো ৪/৫ কিলোমিটার দূরে নোঙর করা এম ভি বে ওয়ান-এ।

এম ভি বে ওয়ান ক্রুস শিপ সেইন্টমারটিন থেকে চট্রগ্রাম এর পথে সেবা শুরু করার আগে এই রুটে ভ্রমণের একমাত্র উপায় ছিলো কক্সবাজার থেকে টেকনাফ বাস বা নিজস্ব গাড়িতে এবং টেকনাফ জেটিঘাট থেকে সেইন্টমারটিন লঞ্চ এ। এম ভি বে ওয়ান এই রুটে যাত্রি সেবা শুরু করায় এখন সেইন্টমারটিন থেকে সরাসরি চট্রগ্রাম পতেঙ্গা জেটিঘাট-এ পৌঁছানো যায় কোন বাহন পরিবর্তনের ঝামেলা ছাড়াই।

এম ভি বে ওয়ান এর পুরনো নাম ছিলো সাল্ভিয়া মারু। এটি তৈরি করেছিলো জাপানের মিতসুবিসি নামক কোম্পানি। এটি বাংলাদেশে আসার পূর্বে জাপানের টোকিও থেকে ওশিমা রুটে যাতায়াত করতো। সাল্ভিয়া মারু বর্তমানে বাংলাদেশের কর্ণফুলী শিপ বিল্ডারস এর মালিকানাধীন এবং এর বর্তমান নাম এম ভি বে ওয়ান । ২০২০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর এই জাহাজটি বাংলাদেশে এসে পৌঁছে এবং ২০২১ থেকে এটি নিয়মিত চট্রগ্রাম থেকে সেইন্টমারটিন রুটে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এম ভি বে ওয়ান ৪৫০ মিটার দীর্ঘ ও প্রস্থে ৫০ মিটার। এই জাহাজটি ২০০০ যাত্রী পরিবহণে সক্ষম এবং এর সর্বাধিক গতিসিমা প্রতি ঘন্টায় ২৪ নটিক্যাল মাইল বা ঘন্টায় ৪৪.৪৮ কিলোমিটার।

আমাদের এম ভি আব্দুল মতিন থেকে এম ভি বে ওয়ান-এ নামার অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিলোনা। মুল গেঁটে প্রচণ্ড জ্যাম আর কোন একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে এখানে হট্টগোল বেঁধে যাওয়ায় আমরা লঞ্চ এর রেলিং টপকিয়ে এম ভি বে ওয়ান-এ প্রবেশ করলাম।

ভেতরে তো আসলাম, এবার আমাদের আসন খুজে বের করার পালা। আমরা মুল গেইট ব্যাবহার না করে জাহাজ এ ঢুকে এক রকম বিপদেই পরে গেলাম। জাহাজ-এর অভ্যন্তরীণ লে-আউট আর সীট প্ল্যান বুঝে উঠতে আমাদের অনেকখানি সময় লেগে গেলো। সবগুলো ফ্লোর পায়চারী করে জাহাজের স্টাফদের সহায়তায় অবশেষে আমাদের সিট খুজে বের করতে পেরেছি আমরা। এম ভি বে ওয়ান-এ সবাই সাধারণত যাওয়া ও আসার জন্য টিকিট করে থাকে কিন্তু আমরা শুধু ফেরার টিকিট টাই করেছি। প্রত্যেকটি বিজনেস ক্লাস সিটের জন্য আমাদের খরচ হয়েছে ৩০০০ টাকা করে। একই সিটে যাওয়া ও আসার জন্য টিকিট করলে খরচ পরবে ৫৪০০ টাকা। সিটের ধরণ ও মুল্য তালিকার জন্য এই লিংকটিতে ঘুড়ে আসতে পারেন। যাই হোক সিটের পাশে আমাদের সাথে থাকা জিনিসপত্র আর লাগেজগুলো রেখে চলে গেলাম জাহাজ এর ছাঁদে।

জাহাজের ছাঁদে খুব সুন্দরভাবে কৃত্রিম ঘাস এর কারপেটিং করা আছে। মন চাইলেই যেখানে সেখানে বসে নীল জলরাশি, ধুলোহীন নির্মল বাতাস আর অথৈ সমুদ্রে ভেসে থাকার স্বাদ এখানে উপভোগ করা যায়। অনেকেই এখানে আসছে। জাহাজের কিনারায় রেলিং এর পাশে দাড়িয়ে জাহাজ আর সমুদ্রের সাথে নিজেকে ফ্রেমবন্দি করছে।

জাহাজের ছাঁদের একটা অংশ ঘেরা দিয়ে নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমরা এখানে আসার পরে আর আমাদের আসনে ফিরে যাইনি। এখানে সময় কাটাতেই বেশী ভালো লাগছে। জাহাজের ছাদে সময় উপভোগ করতে করতেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো। ছাদ থেকে একটি ফ্লোর নিচে নামতেই চোখে পড়লো খাবারের লাইনে দাড়িয়ে খাবার কিনছে সবাই। ২ টি সেট মেন্যু বক্স এখানে। ভুনা খিচুড়ি, চিকেন ও ডিম এর সেট মেন্যু এর লাঞ্চ বক্স এর দাম ৩০০ টাকা এবং প্লেইন পোলাও, সবজী ও চিকেন ফ্রাই এর সেট মেন্যু লাঞ্চ বক্স এর দাম ৪০০ টাকা। প্রতিটি বক্স এর সাথে একটি হাফ লিটার মিনারেল ওয়াটার ছিলো।

ওপেন ডেক হয়ে ছাদে যাবার সময় ওপেন ডেক-এ চলমান কনসার্ট এর সামনে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ গান উপভোগ করে আবার ছাদে এসে বসলাম। ছাদ থেকেও কনসার্ট পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে তবে মৃদু শব্দে। এম ভি বে ওয়ান-এ প্রতিদিন-ই কনসার্ট এর আয়োজন করা হয়। এবং যাত্রীরা কন্সার্টটি যথেষ্ট উপভোগ করছে বলেই মনে হলো এবং গানের ছন্দে ছন্দে আমাদের একটা ভাল সময় কেটে গেলো। গান শুনতে শুনতে এক সময় ছাঁদের ঘাসে আমরা কজন ঘুমিয়েও পরেছিলাম।

দেখতে দেখতে সকাল ১০.০০ টায় শুরু করা যাত্রা ৮ ঘণ্টা পরে সন্ধ্যা ৬.০০ টায় শেষ হলো। আমরা এসে পৌছালাম চিটাগাং এর পতেঙ্গা জেটি ঘাঁটে। এবার বিদায় নেবার পালা। আবারো দেখা হবে নতুন কোনো ভ্রমণ গল্প নিয়ে নতুন কোনো দিনে।